পর্ব ১: আলোকছায়ার খেলায়
গ্রীষ্মকাল। ঢাকার ধুলোমাখা, ক্লান্তিকর দিনগুলো পেছনে ফেলে আদনান ট্রেন ধরে রওনা হয়েছে বরিশালের দিকে। একঘেয়েমি শহরের জীবন, চারপাশে ইট-পাথর, মোবাইল আর কৃত্রিম আলোয় ভরা তার চোখ এখন যেন একটু মুক্তি খুঁজছে। স্কুল বন্ধ, ক্লাস নাইনের বইখাতা রেখে সে আসছে তার নানা বাড়ি—চরভোলা নামে এক গ্রামে, যেটা সে শেষবার এসেছিল পাঁচ বছর আগে, তখন সে অনেক ছোট ছিল।
এইবারের আসাটা ভিন্ন। বয়সটা এখন এমন এক জায়গায়, যখন জগতটাকে বুঝতে ইচ্ছা করে, প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। মা তো বহুবার বলেছে, “নানার বাড়ি গেলে খালি দৌড়াদৌড়ি কোরো না, বিশ্রাম নিও।” কিন্তু আদনান জানে, এবার সে শুধু বিশ্রাম করতে আসেনি। এবার সে অনেক কিছু দেখবে, জানবে। তার মধ্যে কী এক অজানা কৌতূহল কাজ করছে—যেন গ্রামের মাটির নিচে, বাতাসে, পুরনো গাছপালার মাঝে কিছু একটা আছে, যেটা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়।
নানা একসময় মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন। এখন আর আজান দেন না, কিন্তু মসজিদের পাশে তাদের টিনের ঘরে একা থাকেন। অনেক সরল, সাদাসিধে মানুষ। আদনান তাকে খুব পছন্দ করে, কারণ নানার মুখে কোনো ছলচাতুরি নেই। ট্রেন থেকে নেমে ভ্যানে চড়ে গ্রামের পথে ঢুকতেই অন্য এক জগতে প্রবেশ করলো সে। পিচঢালা রাস্তা ফুরিয়ে গিয়ে শুরু হলো কাঁচা রাস্তায় দুলুনি, দুইপাশে ধানক্ষেত, মাঝেমাঝে তালগাছ, আর নীল আকাশের নিচে কোথাও কোথাও ধোঁয়া উড়ছে রান্নার চুলা থেকে।
নানার বাড়িতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। বাড়ির সামনে একটা ছোট পুকুর, পেছনে বাঁশঝাড়, আর ডান পাশে দূরে দেখা যায় একটা পুরনো মসজিদ। সেটাই গ্রামের প্রধান মসজিদ। আদনান ছোট থাকতে শুনেছিল, মসজিদটা নাকি দুইশো বছরের পুরনো। কিন্তু এখন এসে দেখে মনে হয়, সময় যেন সেখানে থেমে আছে। মিনারটা একটু অদ্ভুত দেখতে। সাধারণ গোলাকৃতি না, বরং খানিকটা চৌকোনা, মাথায় ধাতব কিছু একটা বসানো, যেটা রোদের আলোয় চকচক করে।
রাতের খাওয়া শেষ করে নানার পাশে মাটির বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। বিদ্যুৎ চলে গেছে, হারিকেনের আলোয় নানার মুখে গ্রামের পুরনো গল্প শুনছিল আদনান। কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও যেন অস্থিরতা কাজ করছিল। মসজিদটা মনে গেঁথে গেছে। সেই মিনার, সেই পুরনো গম্বুজ—সব কিছুতেই যেন এক ধরনের অস্পষ্ট, অচেনা টান।
তখনই হঠাৎ মসজিদের দিক থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত শব্দ। আদনান চুপ করে শোনে। আজানের সময় হয়েছে, কিন্তু শব্দটা আজানের আগে এল। স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না, তবে মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা ঘষা ঘষি হচ্ছে—মেশিনের মত শব্দ, তারপর হঠাৎ করেই ভেসে এল,
“টিক… টিক… ঝ্যাঁআঁ… আল্লাহু আকবার…”
আদনান উঠে বসে পড়ে। এত বছর আজান শুনেছে, কিন্তু এমন শব্দ সে কখনো শোনেনি। যেন কেউ আজানের আগে কিছুর সংকেত দিচ্ছে। নানাকে জিজ্ঞেস করল, “নানা, এই শব্দটা কি সব সময় হয়?”
নানা একটু হেসে বললেন, “হয় মাঝেমাঝে। প্রায় বিশ বছর ধরে এই রকম একটা আওয়াজ শোনা যায়। কেউ বলে সাউন্ড সিস্টেম নষ্ট, কেউ বলে বাতাসের কারণে হয়। কিন্তু ঠিকভাবে কেউ কিছু বলতে পারে না। আমরা ভাবি আল্লাহর কোনো রহমত, গুরুত্ব না দিয়ে থাকি।”
আদনান কোনো কথা বলল না। কিন্তু মাথার ভেতর কেমন করে যেন একটা সংকেত বেজে উঠল। সে সিদ্ধান্ত নিল—এই শব্দটা আবার শুনতে হবে, রেকর্ড করতে হবে।
পরদিন সন্ধ্যায় সে মোবাইলটা চার্জ দিয়ে রাখল যতটা সম্ভব। রাতে চুপিচুপি মসজিদের পেছনের দিকটায় গিয়ে বসে রইল। সেখানে একটা পুরনো আমগাছ আছে, যার নিচে বসলে মসজিদের দিকটা ভালো দেখা যায়, কিন্তু কেউ তাকে সহজে দেখতে পাবে না। রাত বাড়তে লাগল, চারপাশের কুকুরের ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ—সবকিছু মিলিয়ে যেন একটা ঘোরের সৃষ্টি করছে।
ঠিক ৯টা ১০ মিনিট। হঠাৎ আবার সেই শব্দ।
“টিক… টিক… ঝ্যাঁআঁ… আল্লাহু আকবার…”
আদনান মোবাইল বের করে দ্রুত রেকর্ড করল। শব্দটা কিছুটা পরিষ্কার এসেছে। কিন্তু আজানের আগের সেই টিক টিক শব্দটা, আর যেটা "ঝ্যাঁআঁ" এর মত—সেইটা বেশি স্পষ্ট।
রাতে ঘরে ফিরে হেডফোনে প্লে করল শব্দটা। কয়েকবার শোনার পর তার মনে হল, এই শব্দটা একটা কোড হতে পারে। একটা নিয়মিত প্যাটার্ন আছে। হয়তো এটা মোর্স কোড, কিংবা এমন কোনো সংকেত যেটা মানুষের কণ্ঠ নয়, বরং যান্ত্রিক। মোবাইলেই একটা কোড অ্যানালাইসিস অ্যাপ ইনস্টল করল সে। অ্যাপটা কোনো ফলাফল দিতে পারল না, কিন্তু শব্দটার পিচ এবং ফ্রিকোয়েন্সি বিশ্লেষণ করে বলল, এটা “non-human source”।
পরদিন সকালে স্কুলের কম্পিউটার শিক্ষক জামাল স্যারের কাছে গেল আদনান। স্যারকে পুরো ব্যাপারটা বলল না, শুধু বলল সে একটা অদ্ভুত সাউন্ড রেকর্ড করেছে। জামাল স্যার রেকর্ড শুনে চোখ কুঁচকে বললেন, “এইটা তো রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা কোনো সিগন্যাল সিস্টেমের আওয়াজের মত শোনাচ্ছে। কোথা থেকে রেকর্ড করছো?”
আদনান একটু চুপ করে রইল, বলল, “একটা পুরনো জায়গা থেকে।”
স্যার বললেন, “এইটা কোনো পুরনো ডিভাইস বা সেন্ডার থেকে আসতে পারে। এই রকম আওয়াজ আমরা ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন সিস্টেমে পাই। তবে মসজিদের মিনার বা কোনো কাঠামো যদি ধাতব হয়, তাহলে সেখানে চৌম্বকীয় কিছু থাকতে পারে। তুমি নিশ্চিত জায়গাটা খুঁজে দেখো। আমার মনে হচ্ছে সেখানে কিছু আছে।”
রাতে আবার গেল মসজিদের কাছে। এবার একটু সাহস করে মিনারের নিচে গেল। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মসজিদের পেছনের দেওয়ালে হালকা ফাটল দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে ঢেকে রাখা। দেওয়ালে হাত দিলে সে বুঝতে পারল, এই জায়গাটা অন্য কোথাও থেকে একটু বেশি ঠান্ডা। যেন পেছনে কিছু একটা খালি জায়গা আছে।
মাথার মধ্যে একটানা শব্দ বাজছিল—একটা প্রশ্ন, একটা কৌতূহল, আর একটা ভয়।
তবে ভয় পেলে হয় না। আদনান জানে, সত্যের খোঁজ পেতে হলে সাহস লাগে। সে ফিরে এসে পরের দিন একটা ছোট্ট টর্চ আর একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিল। রাতে আবার গেল সেখানে। ফাটলটা একটু চুলকিয়ে দেখল—হঠাৎ করেই একটা ছোট অংশ খুলে গেল। ভিতরে এক হাত লম্বা গর্তের মত। হাত ঢোকাল সে। ভিতরে ধাতব কিছু একটা। স্পর্শ করতেই ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে, আর কোথাও কোথাও অসমান, যেন ছিদ্র আছে।
এক মুহূর্তে, সেই বস্তুটা হালকা কম্পন শুরু করল। আদনান চমকে উঠল।
তারপর… মিনারের মাথা থেকে হালকা একটা সবুজ আলো বের হলো—মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ড পর সেটা নিভে গেল।
আদনান পেছনে তাকিয়ে দেখল, গ্রামের মানুষ কেউ কিছু টের পায়নি। মসজিদের দিক তাকিয়ে আছে একা সে। তার মনে হচ্ছিল, যেন মিনারটা তাকে ডেকেছিল, তার অপেক্ষায় ছিল।
সবকিছু যেন বাস্তব না, একটা স্বপ্ন।
কিন্তু সে জানে, এটা সত্যি। আর এই সত্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো এক ভবিষ্যতের ইতিহাস, হয়তো কোনো পুরনো প্রযুক্তি, অথবা এমন কিছু যার অস্তিত্বই মানবজাতির ইতিহাসে নেই।
তবে সে জানে, শুরুটা এখানেই।
to be continued
0 Comments